স্টেশনে বসে আছি ঘণ্টা দুয়েক হল। এতক্ষণ একা বসে থাকা খুব বিরক্তিকর হলেও আমার খারাপ লাগছে না। স্টেশনে কত রকম লোক আসছে,যাচ্ছে! কেউ হাসিমুখে ট্রেনে উঠছে, কেউ কাঁদছে প্রিয়জনকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে। একটা ভিখারি পরিবার সংসার পেতেছে স্টেশনের এক কোণায়। রঙ উঠে যাওয়া এক সময়ের লাল টুকটুকে কম্বলে মায়ের কোলে আরামে ঘুমাচ্ছে ছোট্ট একটা মেয়ে বাচ্চা! কি মিষ্টি দেখতে সে!
আমার চারপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নানা রকম হকার! একটা পিচ্চি ভিখারি এসে টাকা চাইল, ভাত খায়নি দুপুরে। আমার এত মন খারাপ হল তার জন্য! কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই। আমি নিজেই খাইনি দুপুরে। অনীকের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এত ক্ষুধা পেয়ে গেল যে একটা চিপসের প্যাকেট কিনে ফেললাম ১০টাকায়। ওটাই খাচ্ছিলাম আর তখুনি মেয়েটা এসে টাকা চাইল। আধখাওয়া চিপসের প্যাকেটটাই ওকে দিয়ে দিলাম আমি।
তারপর সময় দেখলাম। ৮টা ৩৫ বাজে। ট্রেন লেইট। ভালোই হয়েছে তাতে। কারণ অনীক এখনো স্টেশনে এসে পৌঁছেনি। আজ রাত ৮টা ৩০ এর উপবন এক্সপ্রেসে করে আমার আর অনীকের পালিয়ে যাবার কথা। অনীক ট্রেনের টিকেট অনলাইনে কেটে রেখেছে ৩ দিন আগে। এসি স্লিপার কোচ। প্রেমিকের বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে ঘুমোতে যাব।
আমি কোনদিন সিলেট যাইনি আগে।অনীক বলে সিলেট নাকি বাংলাদেশের সবচে সুন্দর জায়গা।লোকে কেন শুধু কক্সবাজারের গল্প করে ও ভেবে পায় না। আমার অবশ্য আপাতত নিজের বাড়িটা থেকে বেরোনো জরুরি। সে সিলেটই যাই আর কক্সবাজার।
অনীককে আমি ভালোবেসে পরম ডাকি। খুব আহামরি কোন কারণে নয়। বরং ওর চেহারায় পরমব্রত টাইপ ক্যারিশমা আছে বলে। আমি দেখতে একদম সাধারণ। ভীষণ সুন্দরী মায়ের রূপ পাইনি, পেয়েছিলাম বাবারটা। আমার বাবা ছোটবেলায় পালিয়ে যান। কোনদিন ফিরে আসেননি। আমি একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাসা ভর্তি নানাবাড়ির লোকজন। সবাই বলাবলি করছে গত ৩ দিন ধরে বাসায় না ফেরা বাবা নাকি কাকে খুন করে ফেরার হয়েছে।
আমি অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা ফেরার মানে কি?’ মা তীব্র ঘৃণা নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘সে তোমার জানতে হবে না। যার চেহারা পেয়েছ তার স্বভাবটাও পেয়েছ কিনা কে জানে!’
আমার বিশ্বাস হয় না কারো কথা। আমার নরম সরম, ভালমানুষ বাবা, যে কিনা একটা পোষা টিয়ার মরে যাবার দুঃখে ৩ দিন অন্নস্পর্শ করেননি, তিনি একটা মানুষকে মেরে ফেলেছেন! আমি অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন। বাবা আমাকে না দেখে থাকতে পারেন না। নিশ্চয়ই ফিরবেন কোন এক গভীর রাতে। আমি মাথার পাশের জানলা খুলে রাখি। পোষা কুকুর মিরিন্ডার মত কান খাঁড়া করে থাকি। বাবা ফেরেন না।
তাকে নিয়ে যা তা কথা বলেন মা। আর আমাকে দেখলে তার চোখে খুন জেগে ওঠে। মনে হয়, বাবার মত চেহারা পাওয়া আমিই বাবা! বাবাকে তো আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে মেরে ফেললে বেশ একটা প্রতিশোধ নেয়া হয়। মা মেরে ফেলেন না আমাকে! কিন্তু এরপর থেকে কারণে অকারণে আমার গালে চড় বসিয়ে দেয়া মায়ের প্রিয় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। আমার কালচে গালে চড়ের দাগ বসে না। কিন্তু মায়ের চোখে একটা তৃপ্তি দেখি আমি। মেনে নিই।
বুঝি মা আমাকে না, বাবাকে মারেন আসলে। আমি বাবার মত দেখতে হয়েছি, মার তো খাবই। বছরখানেক পর মা বিয়ে করলেন আবার। এবার ফরসা একজনকে। সেই লোক কারণে অকারণে আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন না কোন ছুতোয় আমার গায়ের সাথে হাত লেগে যায় তার।
মাকে একদিন বলার পর আমার ধবধবে ফরসা মা রেগে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে মাকে দেখছিলাম আর মা হিসহিসিয়ে বলছিলেন, ‘দেখ নিশাত! এ ধরণের বানোয়াট কথা বলে আমার এটেনশন পাবার চেষ্টা আর কোনদিন করবি না। এত ভালো একটা লোককে নিয়ে মন যা তা গল্প বানাতে মুখে আটকায় না তোর?’ তারপর ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন আমার বাম গালে।
আমি মার খাবার জন্য তৈরি ছিলাম না বলে ছিটকে পড়লাম ফ্লোরে। মায়ের শাড়ি রাখার সাধের আলনার কোণায় লেগে কপাল কেটে গেল আমার। দরদর করে রক্ত ঝরতে দেখেও আমার মায়ের কিছু হল না। উনি উঠে গিয়ে আমার সৎ বাবাকে পাঠিয়ে দিলেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
আমি রক্তের জন্য কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু লোকটার হাতের ছোঁয়ায় আমার সারা গা ঘিনঘিন করতে লাগল। মনে হচ্ছিল এক ধাক্কায় একে রিকশা থেকে ফেলে দিই। পাশের ট্রাক একে পিষে ফেলুক। কিন্তু তাহলে যে আমাকে বাবার মত ফেরার হতে হবে। তদ্দিনে মানে জেনে গিয়েছি এ শব্দের। জেনে গিয়েছি যার চেহারা পেয়েছি, তাকে দেখতে আমাকে আয়নায় দাঁড়াতে হবে। আর কোথাও দেখতে পাব না তাকে কোনদিন।
সে দাগ আমার কপালে এখনো আছে। অনীক মাঝে মাঝে দুহাতে আমার মুখ ধরে তীব্র মমতা নিয়ে সে দাগে হাত বুলায়। এত মমতা বাবা ছাড়া আর কারো চোখে দেখিনি আমি। গত সোমবারে আমার বয়স ১৮ হল। অনীককে বিয়ে করে ফেলার বয়স হয়েছে আমার। হুট করে সেদিনই ওকে সব বলে দিলাম আমি।
আমার কেন কলেজ সেরে ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে না, কেন প্রায়ই গায়ের নানা জায়গায় অদ্ভুত সব দাগ থাকে, সৎ বাবার লোলুপ চোখ দেখলে ভেতরে কেমন খুনের নেশা জাগে,বাবার মত খুন করে ফেরার হতে ইচ্ছা করে সব…সঅঅঅব! ঘুম ভাঙলেই আমার ঘরে ওই লোকটার দাঁড়িয়ে থাকা, আমাকে যখন তখন, যেখানে খুশি ছুঁয়ে দেয়া এসব থেকে আমাকে অনীক বাঁচাবে কিনা জানতে চাইলাম। অনীক বুকে চেপে রাখল আমাকে অনেকক্ষণ। তারপর বলল, এ সপ্তাহেই আমাকে এ নরক থেকে বের করে নেবে ও।
আজ সেজন্যেই স্টেশনে বসে আছি আমি। বাড়ি ছাড়ার সময় বাবার একটা ছোট পাসপোর্ট সাইজ ছবি ছাড়া কিচ্ছু নিয়ে বেরোই নি আমি। আমাকে তেমন জামা কাপড় বানিয়ে দেন না মা। কলেজ ড্রেসেই বেরিয়েছি তাই। অবশ্য মায়ের ড্রেসিং টেবিল থেকে তার সাধের একটা দামি লিপস্টিক তুলে এনেছি গোপনে। ম্যাক এর এই লিপস্টিকের শেডের নাম Ruby Woo! একটা রঙ এত সুন্দর হয়! না কটকটে লাল, না ম্যারুন। রঙটা কি দারুণ মানায় মায়ের ফরসা মুখে। দেখে খুব লাগাতে ইচ্ছা হত আমার।
একদিন না বলে লাগিয়ে মায়ের আয়নায় দেখছিলাম নিজেকে। মা আমাকে চুল ধরে টেনে এনে রান্নাঘরে ফেললেন। আচ্ছামত এলোপাথাড়ি লাথি লাগালেন পড়ে থাকা আমাকে। তারপর লোকে যেভাবে ডলে ডলে মেঝের ময়লা তোলে, অমন করে ঠোঁট থেকে মুছে দিলেন রঙটা। ‘উঃ’ করে উঠলে আরও খেপে কটা লাথি বসিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মা।
আমি স্টেশনের বাথরুমে ঢুকে ঠোঁটে রঙটা লাগাই। কি মিষ্টি দেখতে লাগছে আমাকে! ট্রেন আসার সময় হয়ে গিয়েছে।অ্যানাউন্স করছে কিছুক্ষণের মধ্যে ১ নাম্বার প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবে ট্রেন। অথচ অনীক এখনো এসে পৌঁছুল না। ওর একটু এমন স্বভাব আছে। সময় মেনে কাজ করতে পারে না। আমি ফোন দিই কবার। এই ফোনটা মা আমার কাছে রাখেন রোজ কলেজ থেকে ফিরে কি কি কাজ করতে হবে বলে দেবার জন্য।
ভাগ্যিস রাখেন। নাহলে অনীকের রঙ নাম্বারের কলটাও আসত না! প্রেমটাও হত না। ওই বাড়িতেই ঝিগিরি করে জীবন কেটে যেত! অনীক ফোন তোলে না আমার। চোখের সামনে উপবন এক্সপ্রেস এসে দাঁড়ায়। ব্যস্ত স্টেশনে আমি গলা উঁচু করে আমার পরমকে খুঁজি। কে জানে, ও হয়ত এসেছে! এত লোকের ভিড়ে নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছে।
আবার ফোন দিই ওকে। অস্থির লাগে আমার।আমি কি ট্রেনে উঠে যাব? কিন্তু টিকেট তো অনীকের কাছে। ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে। ছেড়ে দেবে যে কোন সময়। হঠাৎ করেই কেন যেন মনে হয় অনীক আসবে না। কিন্তু আমি যে আর ওই বাড়িতে ফিরতে পারব না এটা কি ও জানে না? মা ফোন দিয়েছেন একের পর এক। আমি ধরিনি। আজ বাড়ি ফিরলে মেরেই ফেলবেন আমাকে। কলেজের পর বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ না করে এত রাত অব্দি বাইরে ছিলাম এ অন্যায় মা মানবেন না।
আস্তে করে ট্রেনের স্পিড বাড়তে শুরু করে। জানলার বাইরে থেকে ভেতরে বসা যাত্রীর হাত ধরে রাখা মানুষগুলোকে একটু জোরে হাঁটতে হয়। আমি হুট করে জেনে যাই কি করতে হবে আমাকে।অনীককে ছাড়াও আমি ওই নরক থেকে বেরোতে পারি। মুক্তি পাওয়ার জন্যে আমার কাউকে লাগবে না। হাতের লিপস্টিকটা চিপসের প্যাকেট হাতে বসে থাকা বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে দিই আমি। তারপর ট্রেনের একদম ইঞ্জিনের বগির দিকে হাঁটতে থাকি।
বেশ জোরে জোরে গাইতে থাকি,
‘আমার জন্য আলো জ্বেলো না কেউ
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরবো না, না, না..’
আশপাশের লোকেরা অবাক হয়ে তাকায়। আমি কাউকে দেখি না। ইঞ্জিনের পাশে পাশে দৌড়াই। খানিকটা সামনে এসে অপেক্ষা করি ট্রেনের স্পিড আরো বাড়ার! মা ঠিকই বলত। আমি কেবল বাবার চেহারাই পাইনি! আমার ভেতরেও খুনি আছে একজন! আজকে আমি বাবার মত ফেরার হব।