বাংলায় কথা কই

ছুটি

শুরুতে ভেবে রেখেছিলাম খুব ভোরে, কেউ জাগার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে যাব। অরুণ ঘুম থেকে জাগে ঠিক ৯টায়। ১০টায় অফিস শুরু ওর। বাচ্চারা বেরিয়ে যায় ৭টা ১৫তে। ওদের স্কুল বাস বাসার নিচে হর্ন দিলে মেয়েটা দৌড়ে নামে, ছেলেটা এটা সেটা খুঁজে পায়না। আমাকেই এগিয়ে দিতে হয়।


দুজনের কেউই সকালে ব্রেকফাস্ট গিলতে পারেনা, তবু সাজিয়ে দিই টেবিলে। কোন একদিন মন চাইলে এক স্লাইস ব্রেড আর একটু অরেঞ্জ জুস গিলে বেরোয় বাচ্চারা। ছুটা বুয়া ঢোকে ১১টায়। সবাই বেরোবার পর। এসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দেয় আমার সাথে। কোন এপার্টমেন্টে কে এলো, কে হাজবেন্ড বাসায় না থাকলে অন্য পুরুষ ডাকে বাসায়, সব তার নখদর্পণে।


আমি হ্যাঁ/না কিছুই বলিনা। প্রথম কদিন তাকে থামাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি এখন। সে নাকি কথা না বলে কাজ করতে পারেনা। আজ সে আসার আগেই বেরোতে হবে। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি আমি। কক্সবাজারে হোটেলে রুম বুক করেছি নিজেই। প্লেন টিকেট কাটতে ফোন দিয়েছি এক পুরনো বন্ধুকে যে ট্রাভেল এজেন্সি চালায়। দাম শুনে খটকা লাগায় ছেলের ফোনের গো জায়ান অ্যাপ থেকে নিজে চেক করে দেখি অনেক চিপার। বুক করে নিয়েছি।


চাইলে নিজের ফোন থেকে করতে পারতাম। কেউ জানত না কোথায় গিয়েছি আমি। কিন্তু কিছু হিন্ট ইচ্ছে করেই রাখলাম। চাইলে এখনো সব নিজে নিজেই করতে পারি ভেবে কনফিডেন্ট লাগছে বেশ। অরুণের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই ফিল হচ্ছেনা কেন যেন। অথচ কি তীব্র প্রেমের বিয়ে! মানুষটাও কি ভীষণ ভালো। পুলিশি ঝামেলা হলে এই মানুষটা ফেঁসে যাবে ভেবেই কষ্ট হচ্ছে। একটা নোট কি রেখে যাব?


বাসার বুয়া, দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে কিছুই পাবেনা পুলিশ। আদ্যপান্ত সুখী পরিবার দেখে সবাই। আসলেও কি তাই নয়? নিজেকে ধমক লাগাই একটা। এখনো কেবল স্বামী-সন্তানদের কোথাই ভাবছি। আজ নিজের কথা ভাবব, কথা দিয়েছি নিজেকে।
অরুণ বেরিয়ে যাবার আগে একবার জড়িয়ে ধরে আদর করে যায় আমাকে। সেটা নিতে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আজ। ওকে আরেকবার দেখে নিলাম আমি। কি সুদর্শন একটা মানুষ! ৪২ এ এসেও সেই ২৬ বছরের তরুণের মতই দেখাচ্ছে ওকে যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তখন। লোকটাকে আসলেই বোকার মত ভালোবাসি আমি।


আমি বেরোতে পারছিনা। ঘরের এটা গুছিয়ে, কিছু খাবার বানাতে বানাতে বুয়া চলে এলো। ওর সঙ্গে থেকে সব দেখিয়ে না দিলে কাজ বাড়িয়ে রেখে যাবে! কে করবে সেসব? মেয়েটা scrambled eggs ছাড়া কিছু বানায়নি কখনো। ছেলেটা পাস্তা। অরুণ টুকটাক করে সামলে নেবে কিন্তু সে তো ফিরবে রাত ১১টায়।


দুপুরের রান্না সেরে ক্ষুধা পেয়ে গেল আমার। সময় এত দ্রুত কেন যায়? ভাগ্যিস ৩টা ৪৫ এর ফ্লাইট টিকেট কিনেছি। একটু শাওয়ার নিয়ে, নামায পড়ে নিই। তারপর খেয়েই বেরিয়ে যাব। ছেলেমেয়েরা ফিরবে সাড়ে ৩টায়। সময় আছে তার আগেই বেরোনোর।
শাওয়ারে থাকতেই ফোন বাজছে আমার। ক্রমাগত। খুব অসহ্য ব্যাপার। আমি টাওয়েল জড়িয়ে বেরোতেই দেখি আবার একটা অচেনা নাম্বারের ফোন। ধরতেই শুনি সুতপা স্কুলে অজ্ঞান হয়ে গেছে,স্কুল থেকে ওকে এভারকেয়ারে পাঠিয়েছে। আমাকে এখুনি যেতে বলছে।কি করি এখন? ড্রাইভারকে আজ আসতে মানা করেছিলাম। প্ল্যান ছিল উবার নিয়ে এয়ারপোর্ট চলে যাবার। ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে আসলে তো সবাই জেনেই যেত কোথায় যাচ্ছি!


টেনশনে ঠোঁট কামড়াবার স্বভাব আমার। খুব টেনশন হচ্ছে মেয়েটার জন্য কিন্তু গেলে ফ্লাইট মিস হবে নিশ্চিত। আর এবারো মিস হলে গত প্রতিবারের মত আমার আর নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করা হবে না। প্রতিবছর একবার অন্তত দেশের বাইরে যাই আমরা। দেশের ভেতর যেখানে ফ্লাইটে যাওয়া যায় সেখানে যাওয়া হয়।ব্যাকপেইন বাড়ে নাহলে আমার। তবু কোথাও থেকে ফিরে আমার মনে হয়না একটু বেরিয়ে এসেছি আমি।


ওখানেও আমি সুতপা, অঙ্গনের মা থাকি সারাটাক্ষণ। অরুণের মেডিসিন, খাবার বুঝে অর্ডার করা সব আমার হাতেই। আমি সাথে যাই ওদের ম্যানেজার হয়ে। কাজের খাতিরে। প্রতিবছর মার্চের ৮ তারিখে এটা সেটা ক্যাম্পেইন দেখে নিজেকে মূল্যবান লাগে খুব। নিজের যত্নের কোথা মনে পড়ে। নিজেকে সময় দেয়ার একটা কিছু প্ল্যান করি আর সেটা ভেস্তে যায় কোন না কোনভাবে! এজন্য কাউকে না বলে এবার গোপনে সব রেডি করে রেখেছিলাম। বললে কোন না কোনভাবে যাওয়া বাতিল হত,তাই। এবার কিছুতেই বাতিল হতে দেয়া যাবেনা! কিন্তু হসপিটালে গেল কোনভাবেই ফ্লাইট ধরতে পারব না আমি।


কতবছর ড্রাইভ করিনা। রাস্তায় নেমে আমার মনে হল, মেয়েটা তো হসপিটালে ডক্টরের হেল্প পাচ্ছেই। অরুণকে ফোন করে যেতে বলি। এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে যাব আমি। তবু ফ্লাইট মিস হবে আমার? পাশ দিয়ে হর্ন দিতে দিতে একেবেকে কয়েকটা বাইক গেল। এক্সিডেন্ট করিয়ে ছাড়বে এরা! ডিসিশন নিতে পারছি না কি করব আমি!


নারী দিবস আসে যায়, নারীর কি কোন দিবস আসে আদতে? একটা দিন শুধু নিজের মত করে পাবার দিন? ঘড়িতে ৩টা ২৭। চাইলে এখনো ফ্লাইটটা ধরতে পারি আমি। চোখে ভাসছে সাগরপাড়ে নতুন কেনা শাড়িটা পরে একা বসে আছি চুপচাপ সে দৃশ্য! পরক্ষণেই চোখে ভেসে উঠল আমার সুতপার মুখটা। মা হওয়া আসলে একটা ২৪ ঘণ্টার চাকরি, বছরের ৩৬৫ দিন। আমার ছুটিটা মনে হয় এবছরও মিলবে না! নতুন কেনা গাঢ় নীল শাড়িটা পরে বেরিয়েছিলাম। থাক সামনের বছর আবার দেখা যাবে!
(অনেক বছর কিছু লিখিনা আমি। কোন গল্পও মাথায় আসেনা সেভাবে। আজ সকালে হঠাৎ আসা গল্প(!) লিখে রাখলাম। গল্পের চরিত্রেরা সবাই কাল্পনিক!)


Happy women’s day to all the strong, confident, relentless women out there. Your sacrifices may go unnoticed, but you sure make this world liveable. Don’t forget to take a little care of yourself too. You deserve it <3
Sincerely, Zana

Zana

Stumbled upon my blog and wondering who I am?
Hi, I'm Farzana! Nice meeting you! I'm a teacher, mental health advocate, travel enthusiast, and foodie who happens to be a writer as well! A living example of a jack-of-all-trades(master of some)! Look around, get cozy, let me know what you think of my humble abode!

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *